বীরমুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এমএম নজরুল ইসলামের জীবনাবসান হয়েছে। তিনি ছিলেন মণিরামপুর উপজেলা আওয়ামীলীগের স্পনন্দন। চরম দুর্দীনে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনকে মজবুত করেছেন। তার হাত ধরেই এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতার উত্থান হয়েছে। দীর্ঘদিন তিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একাধারে ছিলেন সংগঠক, শিক্ষানুরাগী. মানবদরদি নেতা ও সমাজ সেবক।
এমএম নজরুর ইসলাম ১৯৪৯ সালের ২৩ অক্টোবর মণিরামপুর উপজেলার সদর ইউনিয়নের হাজরাকাটি গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তার বাবার মৃত আব্দুল মোল্লা ও মা মৃত আমেনা খাতুন। ৪ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝ। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী। বছর ১৫ আগে তিনি ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে প্রাণ ফিরে পান। গত ১৩ জানুয়ারি তিনি অসুস্থ্য হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে যশোরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে খুলনা সিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার রাত ৯.২৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ২ ছেলে ও ৩ মেয়েসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।কিশোর বয়সেই তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রানিত হন। ১৯৬৬-এর ৬দফার প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। ১৯৬৯ সাল থেকেই গণ আন্দোলনের জন্য জনমত গঠনে সংগঠন মজবুত করতে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭০ সালের বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ অগ্নিঝরা ভাষনের পর যুবকদের সংগঠিত করেন। পাকিস্তান সরকারের কথামতো ২৫ মার্চ উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের তৎকালিন ইউপি চেয়ারম্যান মহসীন রাইফেল জমা দিতে বের হন। এদেশের সাধারন জনগনের ওপর ব্যবহার করা হবে বলে তার নেতৃত্বে পথিমধ্যে থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ৪ঠা এপ্রিল তিনি ভারতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকেই যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রানিত করেন।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে শাহাদাৎ বরণ করলে তিনি গ্রেফতার হন। প্রায় দেড় বছর কারাবরণ করেন তিনি। আওয়ামীলীগের দুর্দীনে ১৯৭৮ সাল থেকে টানা দুই বার তিনি উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। মণিরামপুর সদর ইউনিয়ন থেকে ইউপি চেয়ারম্যানসহ ১৯৮৭ সালে উপজেলা পরিষদের উপ-নির্বাচনে তিনি জয়ী হন। পরবর্তিতে উপজেলা নির্বাচনে দলীয় তৃণমুল নেতার ভোটে মনোনয়ন পেয়ে ফের নির্বাচন করেন। কিন্তু দলীয় একটি পক্ষ আরেকজনকে প্রার্থী করায় তিনি সামান্য ভোটে পরাজিত হন।তিনি শুধু রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগি। তার একক প্রচেষ্টায় মণিরামপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ, ফাজিল মাদ্রাসা, জালঝারা সিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদ্রাসা, মণিরামপুর আদর্শ সম্মেলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ছিলুমপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান দাড় করিয়েছেন। নিজের বাড়ি-ঘরের পলেস্তারা না থাকলেও তিনি মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করিয়েছেন।
বীরমুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা “গার্ড অব ওয়ানার” প্রদান করা হয়। এসময় নেতৃত্ব দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) হরেকৃষ্ণ অধিকারী। উপস্থিত ছিলেন প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম মিলন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আলাউদ্দীন। এর আগে মরহুমের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তার কফিনে ফুলের শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন করা হয়। পরে জানাযা নামাজের জন্য মণিরামপুর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে মাঠে তার মরদেহ নেওয়া হয়।জোহরবাদ ওই বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত মরহুমের জানাযা নামাজ পূর্বক সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভায় এলজিআরডি মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য বক্তব্য প্রদানকালে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি স্মৃতিরোমন্থন করতে গিয়ে বলেন, প্রায় ৫২ বছর মরহুম এমএম নজরুল ইসলামের সাথে এক সাথে চলা। কখনো তার সাথে কিঞ্চিত পরিমান মনমালিন্য হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক সাথে থাকা, ৭৫’পরবর্তিতে এক সাথে কারাবরনসহ নানা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, তার আজকের অবস্থানে আসার নেপথ্যে মরহুম এমএম নজরুল ইসলামের অবদান রয়েছে।
এসময় বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন যশোর জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি পৌর মেয়র কাজী মাহমুদল হাসান, উপজেলা বিএনপির আহবায়ক অ্যাড. শহীদ মোঃ ইকবাল হোসেন, উপজেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক প্রভাষক ফারুক হোসেন, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা খানম, সাবেক চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন লাভলু, বিএনপি নেতা মফিজুর রহমান, আওয়ামীলীগ নেতা জিএম মজিদ, অ্যাড. বশির আহম্মেদ খান, উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চু, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান কাজী জলি আক্তার, ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মুরাদুজ্জামান মুরাদসহ বিভিন্ন স্তরের সামাজিক-রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধিবৃন্দ।এদিকে রাতে তার মুত্যুর পর খবরটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এদিন রাত প্রায় ১টার দিকে মরহুমের মৃতদেহ নিজ বাসভনে আনা হয়। সেখানে বহু নেতা-কর্মী অপেক্ষা করতে থাকেন।নামাজের জানাযা শেষে মরহুমের মরদেহ গ্রামের বাড়ি হাজরাকাঠিতে নেওয়া হয়। সেখানে পিতা-মাতার কবরের পাশে তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হন।
আপনার মতামত লিখুন :