স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালুর সাথে সাথে বদলে যাবে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল। বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। সমানতালে বৃদ্ধি পাবে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ। বাড়বে চিকিৎসা, ভ্রমণসহ নানা কারণে পাসপোর্ট যাত্রীদের যাতায়াত। এ নিয়ে স্থানীয় কাস্টমস, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, ব্যবসায়ীসহ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে সংযুক্তরা স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন। সমানতালে চলছে বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ অন্যান্য কার্যক্রম।
# ফেরির বদলে সেতুতে আমদানিকারকদের খরচ কমবে।
# বাড়বে স্থলবন্দরের ব্যবহার
# বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য।
# রাজস্ব দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা ।
# পাসপোর্ট যাত্রী বৃদ্ধিতে বাড়বে রাজস্ব আয় ।
# ভারতীয় অংশেও কর্মচাঞ্চল্য বাড়বে
# পরিবহনগুলোর হবে দিনে দুটি ট্রিপ ।
স্থানীয় কাস্টম, বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বছরে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হয় সরকারের। ভারতের কোলকাতাসহ পার্শ্ববর্তী প্রদেশসমূহ থেকে সহজেই বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে পণ্য আমদানি করা যায় বলে ব্যবসায়ীদের কাছে এই বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম। ফলে, দেশের অন্যান্য বন্দরের তুলনায় ব্যবসায়ীরা বেনাপোল বন্দরকে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বেশি ব্যবহার করেন। ২৫ জুন দেশবাসীর কাঙ্খিত পদ্মাসেতু চালুর পর ২৬ জুন শুরু হবে যানবাহন চলাচল। তখন থেকে দেশের বৃহত্তম এই স্থলবন্দরটিতে চাপ বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। মূলত, সহজে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ অবারিত হওয়ার সুবিধায় এই বন্দরটি হয়ে উঠবে আমদানিকারকদের কাছে আরও কাঙ্খিত। এতে, ব্যবসায়ীরা যেমন আর্থিকভাবে সাশ্রয়ী হবেন তেমনি ভোক্তা পর্যায়েও পণ্যের মূল্য কমে আসবে বলেও আশা ব্যবসায়ীসহ বন্দর ব্যবহারকারী ও কর্মকর্তাদের।বেনাপোলের কাস্টম কমিশনার আজিজুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেন, পদ্মাসেতু উদ্বোধনের সাথে সাথে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলা এর সুফল ভোগ করবে। তারমধ্যে বেনাপোল কাস্টম হাউজ, বেনাপোল বন্দর সুফল পাবে। আমদানি করা পণ্য সরাসরি বেনাপোল বন্দর থেকে পদ্মাসেতুর ওপর দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে ঢাকাতে পৌঁছে যাবে আগে এটা ফেরিতে যেতো। এতে আমদানিকারকদের খরচ সাশ্রয়ী হবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সুযোগ বেশি পাওয়ার কারণে বেনাপোল স্থলবন্দরের ব্যবহার বেড়ে যাবে, বৃদ্ধি পাবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য। তাতে সরকারের রাজস্ব বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যদিকে, পাসপোর্ট যাত্রী বৃদ্ধি পেয়ে এ খাতেও রাজস্ব আয় বাড়বে। এক কথায় পদ্মাসেতুর প্রভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে বেনাপোল স্থলবন্দরে, মনে করেন তিনি। একমত দিয়েছেন বেনাপোল স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার। তিনি বলেন, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের শতকরা ৭৫ শতাংশ সম্পন্ন হয় বেনাপোল বন্দর দিয়ে। এখান থেকে বছরে সরকারের রাজস্ব আয় হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ওপরে। পদ্মাসেতু চালু হলে এই বাণিজ্য দ্বিগুণেরও বেশি হবে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে। পাশাপাশি নদীপথ এড়িয়ে সড়ক পথ ব্যবহার করায় পণ্য নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাবে অতি অল্প সময়ে। এতে ব্যবসায়ীদের লাভ হওয়ার পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানিতে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ ভারত চেম্বারের ডাইরেক্টর মতিয়ার রহমান বলেছেন, পদ্মাসেতু চালু হলে শুধু বেনাপোল না, ওপারে ভারতীয় অংশেও কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যাবে। বেনাপোলে যেভাবে জরুরি পণ্য বিশেষ করে ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল, অক্সিজেন গ্যাস, কার্বোনডাই অক্সাইড আসে-এগুলো শিল্পের অপরিহার্য অংশ। এগুলো বেনাপোল থেকে পাঠাতে হলে আগে প্রায় একদিন লেগে যেতো। এখন বেনাপোল থেকে তা সরাসরি মাত্র চার ঘণ্টায় ঢাকায় চলে যাবে। এমনও হবে, পরিবহনগুলো দিনে দুটি করে ট্রিপ পরিচালনা করতে পারবে। এটাতে ব্যয় এবং সময় সাশ্রয় হবে। পদ্মাসেতুকে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য সৌভাগ্য বলে অভিহিত করেছেন বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ভারত। তিনি মনে করেন পদ্মাসেতু চালুর পর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের সাথে দেশের বাণিজ্য অনেকগুণ বৃদ্ধি পাবে। তার মতে, দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে কলকাতাসহ ভারতের পার্শ্ববর্তী প্রদেশসমূহ থেকে পণ্য আমদানিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন ব্যবসায়ীরা। কারণ, বেনাপোল থেকে কোলকাতার দূরত্ব কম। পাশাপাশি বেনাপোল একটি আন্তর্জাতিক মানের বন্দর। এসব কারণে ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য বেনাপোল বন্দর ব্যবহার করায় স্বাচ্ছন্দবোধ করেন বেশি।সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেকপোস্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সুলতান মাহমুদ বিপুল বলেন, পদ্মসেতুর উদ্বোধন নিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের সাথে জড়িতসহ বেনাপোল বন্দরের সকল স্টেকহোল্ডার অত্যন্ত আনন্দিত। বেনাপোল দিয়ে যে পচনশীল দ্রব্য আমদানি হয় সেগুলো দিনের দিন ডেলিভারি হয়ে ঢাকায় পৌঁছে যাবে। পণ্যবাহী ট্রাক নিয়ে ফেরিঘাটে কয়েকদিন বসে থাকায় পণ্যগুলো পচে যেতো। অনেক সময় আমদানিনির্ভর কাঁচামাল নির্ধারিত সময়ে ফ্যাক্টরিতে পৌঁছুতে না পারায় অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ থাকতো। এখন তা আর হবে না। তিনি বলেন, ‘এসব কারণে আগামী ২৫ জুন আমাদের উৎসবের দিন’।বেনাপোল আমদানি ও রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহসিন মিলন পদ্মাসেতু চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারী হিসেবে আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো পদ্মাসেতু করা হোক। সেটা আজ বাস্তবে রূপ লাভ করায় আমরা খুবই আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত’।তিনি বলেন, এখান থেকে একটি ট্রাক ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ভাড়ায় পণ্য নিয়ে ঢাকায় যায়। পদ্মাসেতু চালু হলে খরচ কমে আসবে। বিশেষ করে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আসা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও গার্মেন্টস কাঁচামাল দ্রুত ফ্যাক্টরিতে পৌঁছুবে। এতে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে এবং বাজারে পণ্যের মূল্য কমে যাবে। সবমিলিয়ে বেনাপোল বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণ্যিজ্য বৃদ্ধি পাবে বহুগুণে। বাড়বে সরকারের রাজস্ব।বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতি ও বেনাপোল ট্রাক মালিক সমিতির চেয়ারম্যান আজিম উদ্দীন গাজী বলেছেন, স্বপ্নের পদ্মাসেতুর কারণে বেনাপোল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দ্রুত পণ্য পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি পণ্যও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দ্রুত এখানে এসে পৌঁছাবে। এতে এই বন্দর ব্যবহার বেড়ে যাবে। তবে, পদ্মাসেতুর নির্ধারিত টোল কমানোর দাবি জানিয়েছেন তিনি। তার মতে, ‘টোল অন্তত অর্ধেক করলে ভালো হতো। আমরা সুবিধা পাচ্ছি, সুবিধার জায়গায় অর্থের কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে। আমরা সুপারিশ করবো সরাসরি আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি পাসপোর্ট যাত্রীর সংখ্যাও বাড়বে বলে আশা করেন বেনাপোল ইমিগ্রেশনের ওসি মোহাম্মদ রাজু। তিনি বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ফের ভারতের সাথে পাসপোর্ট যাত্রী আসা-যাওয়া শুরু হয়েছে। পদ্মাসেতু হলে দেশের দূরবর্তী স্থান থেকে অনেক মানুষ সহজে বাসে করে বেনাপোলে আসা-যাওয়া করতে পারবেন। সেই সাথে রয়েছে ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেনে আসা-যাওয়ার সুবিধা। তাছাড়া, এখান থেকে কোলকাতার দূরত্ব দেশের অন্যান্য বন্দর থেকে কম। তিনি বলেন, পাসপোর্ট যাত্রী বৃদ্ধির কারণে সরকার এই বন্দর থেকে রাজস্ব বেশি পাবে।
আপনার মতামত লিখুন :